Apr
বরিশাল অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ফ্রিল্যান্সিং পেশা
ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার সুবাদে বরিশাল অঞ্চলে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিং পেশা। দশ বছর আগেও বরিশাল অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষ জানত না আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিং কী। এখন সেই ফ্রিল্যান্সিং পেশাতেই ক্যারিয়ার গড়ছেন অনেকে।
বরিশাল অঞ্চলের মানুষ আউটসোর্সিং সম্পর্কে প্রথম ধারণা পায় ২০১০ সালের পর সরকারের এটুআই প্রকল্পের মাধ্যমে। প্রাথমিকভাবে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে আয়োজিত আইটি-বিষয়ক সেমিনারগুলোর মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীরা প্রথম আউটসোর্সিং সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন। তখন অনেকের কাছেই বিষয়টি অলীক কল্পনা বলে মনে হতো। মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে এখন বরিশাল অঞ্চলে তৈরি হয়েছে অন্তত পাঁচ শতাধিক প্রফেশনাল ফ্রিল্যান্সার। যারা এখন ফ্যিল্যান্সিং বা আউটসোর্সিংকেই তাদের একমাত্র পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তারা এখন বরিশাল অঞ্চলে অবস্থান করে বিভিন্ন দেশের বায়ারদের কাজ করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন, যা ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বরিশাল অঞ্চলে।
প্রথম দিকে বরিশাল অঞ্চলের ফ্রিল্যান্সাররা ইন্টারনেটের ধীরগতি, পেশাদার প্রশিক্ষণ সেন্টার না থাকা, সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবসহ নানা সমস্যার মধ্যে কাজ করলেও এখন আর সেসব সমস্যা নেই। ইতোমধ্যে বরিশাল অঞ্চলে গড়ে উঠেছে অনেক প্রফেশনাল আইটি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রফেশনাল ট্রেনিং পেয়ে অনেকেই আউটসোর্সিং বিষয়ে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে সক্ষম হচ্ছেন। তা ছাড়া সরকারের আইসিটি মন্ত্রণালয়, কারিগরি শিক্ষা অধিদফতর এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে চলছে একাধিক আইটি প্রশিক্ষণ কোর্স। শত শত শিক্ষার্থী ও বেকার যুবক এসব কোর্সে অংশগ্রহণ করে আউটসোর্সিং সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করতে পারছেন।
আইসিটি মন্ত্রণালয়ের আইসিটি ডিভিশনের অধীনে হাইটেক পার্ক প্রকল্পের আওতায় শেখ কামাল আইটি ট্রেনিংয়ে বরিশালে নিউজেন পরিচালনা করছে ২ডি এবং ৩ডি অ্যানিমেশন কোর্স, ডিভাইন আইটি পরিচালনা করছে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট কোর্স, লিডস করপোরেশন ও আইবিসিএস প্রাইমেক্স পরিচালনা করছে ডিজিটাল মার্কেটিং কোর্স। এ ছাড়াও বরিশালে বেশ কয়েক বছর ধরে সেইফ ও শিপ আওয়ার প্রজেক্টের মাধ্যমে চলছে আইটির বিভিন্ন কোর্স। এসব কোর্সে অংশ নিয়ে আইটির বিভিন্ন বিষয় ও আউটসোর্সিং সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা পাচ্ছেন বরিশাল অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা।
বরিশাল বিএম কলেজের দু’টি কম্পিউটার ল্যাবে চলমান নিউজেন ও ডিভাইন আইটির বরিশালের কোর্স সমন্বয়ক যথাক্রমে মো: আল আমিন ও তরিকুল ইসলাম জানান, এসব কোর্সে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের প্রথম তিন মাস বেসিক আইটি ও বেসিক ইংলিশ শেখানো হয়। এরপর আইটির নির্দিষ্ট বিষয়ে তাদেরকে দক্ষ করে তোলা হয়। এর মাধ্যমে তারা আউটসোর্সিং সম্পর্কেও সম্যক ধারণা আর্জন করতে পারছেন।
সরকারি এসব উদ্যোগের পাশাপাশি বরিশালে বেসরকারি উদ্যোগেও গড়ে উঠেছে একাধিক আইটি প্রতিষ্ঠান। তারাও আইটি ক্ষেত্রে দক্ষ জনবল তৈরির জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি বরিশালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় আইটি প্রতিষ্ঠান সাতরং সিস্টেমস। একই বছরের ৯ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের নিবন্ধন লাভ করে। এই প্রতিষ্ঠানে আইটির বিভিন্ন বিষয়ে বর্তমানে ১৫টি কোর্স পরিচালিত হচ্ছে। এসব কোর্স পরিচালনার জন্য ট্রেইনার রয়েছেন ২০ জন। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানে কোর্স সম্পন্নকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা দুই হাজারের বেশি। এদের মধ্যে আউটসোর্সিং কোর্স সম্পন্ন করেছেন প্রায় তিন শতাধিক শিক্ষার্থী, যাদের অনেকেই এখন প্রতিষ্ঠিত ফ্রিল্যান্সার।
সাতরং সিস্টেমসের চেয়ারম্যান মো: তারিকুল ইসলাম সিকদার বলেন, কারিগরি ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরির লক্ষ্য নিয়ে মানসম্মত আইটি ট্রেনিং অব্যাহত রেখেছে সাতরং সিস্টেমস।
বরিশাল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী জুনায়েদ হোসেন ও বিএম কলেজের সমাজকল্যাণ বিভাগ থেকে মাস্টার্স উত্তীর্ণ শাহনাজ ইভা জানান, তারা সাতরং সিস্টেমস থেকে আউটসোর্সিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন ঘরে বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রতি মাসে গড়ে ২৫ থেকে ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করছেন। কাজের ধারাবাহিকতা থাকলে এবং নিজেদের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হলে এই আয়ের পরিমাণ আরো বাড়বে বলে মনে করছেন তারা।
সাতরং আইটি ট্রেনিংয়ের আউটসোসিংয়ের প্রশিক্ষক ও পেশাদার ফ্রিল্যান্সার মাসুদ রানা বলেন, এখানে অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং, এসইও, এসএমএম এবং গ্রাফিক বেইস আউটসোর্সিংসহ মার্কেট প্লেস বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এরপর কাজ বিড করা থেকে কাজ পাওয়া, কাজ শেষ করে বায়ারদের অ্যাকাউন্টে আপলোড করা এবং সবশেষে উপার্জিত টাকা দেশে আনার পদ্ধতিও হাতেকলমে শেখানো হয়। সফলভাবে কোর্স সম্পন্নকারীদের আউটসোর্সিংয়ের কাজ পেতে সহায়তাও করা হয় এখানে। ইতোমধ্যে সাতরং আইটি ট্রেনিংয়ের বেশ কয়েজন শিক্ষার্থী আউটসোর্সিংয়ের কাজ করে এখন বেশ ভালো আয় করছেন।
সাতরং সিস্টেমস অফিস ঘুরে দেখা যায়, এখানে রয়েছে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎব্যবস্থা ও অত্যাধুনিক নেটওয়ার্ক-সমদ্ধ তিনটি কম্পিউটার ল্যাব। এসব ল্যাবে রয়েছে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ও ওয়াফাই কানেকশনসহ ৩২টি কম্পিউটার, প্রতি ব্যাচে ভর্তি করানো হয় মাত্র ১০ জন ছাত্রছাত্রী। এ কারণে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীই পাচ্ছেন আলাদা কম্পিউটার ফ্যাসিলিটি। ভাণ্ডারিয়া থেকে আসা স্কুলশিক্ষক সুকেশ মণ্ডল জানান, কয়েক বছর অগে আমি ভাণ্ডারিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে একটি সেমিনার থেকে আউটসোর্সিং বিষয়ে প্রথম জানতে পারি। এরপর এ বিষয়ে আরো জানার জন্য খোঁজখবর নিয়ে বরিশালের আইটি প্রতিষ্ঠান সাতরং সিস্টেমস সম্পর্কে অবহিত হয়ে এখানে ভর্তি হই। এখানে প্রফেসনাল ট্রেইনারের মাধ্যমে কাজগুলো হাতে কলমে শিখতে পেরেছি।
সাতরং সিস্টেমস থেকে আউটসোর্সিং বিষয়ে সফল ক্যারিয়ার অর্জনকারী সালেহীন সানী ও জিল্লুর রহমানসহ আরো কয়েকজন প্রশিক্ষণার্থী জানান, আউটসোর্সিং সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা অর্জন করে উপার্জন করতে হলে সাতরং সিস্টেমসের কোনো বিকল্প বরিশালে নেই।
বরিশালের আইটি বিশেষজ্ঞ ও প্রফেশনাল অ্যাফিলিয়েট মার্কেটার মোহাম্মদ সিফাত বলেন, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে আইটিতে দক্ষ জনবল তৈরির ব্যাপক কাজ চলছে বরিশাল অঞ্চলে। তবে সরকারি উদ্যোগে বেশিসংখ্যক মানুষ ফ্রি প্রশিক্ষণের সুযোগ পেলেও সফলতার হার কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বেশি। কারণ সরকারি প্রতিষ্ঠানের টেন্ডারের নানা বাধ্যবাধকতা, প্রশিক্ষণার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যোগ্যতার চেয়ে তদবিরকে প্রাধান্য দেয়া, প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা কম্পিউটারের ব্যবস্থাসমৃদ্ধ কম্পিউটার ল্যাব না থাকাসহ নানা কারণে এসব ট্রেনিংয়ের কাক্সিক্ষত সফলতা আসছে না। এসব বিষয়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের ট্রেনিংয়ে আরো ভালো ফল এসিভ করা সম্ভব। এ জন্য ট্রেনিংয়ের তদারকি সংস্থাগুলোকে আরো সক্রিয় করতে হবে।
বরিশালের জেলা প্রশাসক এস এম অজিয়র রহমান বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে সরকারের এটুআই প্রকল্পের অধীনে সারা দেশের মতো বরিশালেও ব্যাপক কাজ হচ্ছে। ফ্রিল্যান্সিং কিংবা আউটসোর্সিংয়ে দক্ষ জনবল তৈরির লক্ষ্যে আইসিটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে হাইটেক পার্কের আওতায় বরিশালে সরকারি ব্যবস্থাপনায় একাধিক প্রশিক্ষণ কোর্স ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে, আরো বেশ কয়েকটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। তা ছাড়া বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রফেশনাল আইটি কোর্স পরিচালনা করছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বরিশাল অঞ্চলে আরো বেশ কিছু প্রফেশনাল ফ্রিল্যান্সার তৈরি হবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন জেলা প্রশাসক।
সূত্র : নয়া দিগন্ত
Sorry, the comment form is closed at this time.